Being Women

হৃদয় এখনও বাংলা মাধ্যম

ট্রেনের জানলা দিয়ে আলগোছে বাইরে চেয়ে দেখি, হলুদ বসন্ত এসেছে। কোথাও কোথাও ফুটি ফুটি পলাশ। শাড়ি আর পাঞ্জাবির রঙে চরাচর আলো হয়ে আছে। মনটা খুশি খুশি হয়ে যায়।

এ মন এখনও কাটিয়ে উঠতে পারল না সারস্বত আটপৌরে কল্কার ভিটেমাটি মোহ। স্কুল জীবন কেটেছে বাংলা মাধ্যমে। সরস্বতী পুজোর বাসন্তীরং রোদ্দুর, হাওয়ায় লাগা হলুদ ধনেখালি ডুরের চৌকোনা নেশা, দই-খইয়ের সুঘ্রাণ, টুকরো ফলের কাঠের বারকোশ, প্রকাশ্য রাজপথে আগল ভেঙে হাতের আঙুলে সাহসী চাপ, বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে উঠতি বাবরিদের ভিড়, কক্ষনো সাহস করে কাছে ঘেঁষতে না পারা দিদিমণির সর্ষেফুলরং শাড়ির পাড়ের ঘেরটুকু ছুঁয়ে পদ্মপাতার মত পা’দুটিতে বুক ধুকপুক নিয়ে হাত ছুঁইয়ে নেওয়া, সদ্য ধুয়ে শুকোনো সুগন্ধী চুলের রাশি দমকা বাতাসে সামলাতে সামলাতে হাঁটার চেষ্টা করা অচেনা মেয়েটির মনে থেকে যাওয়া চোখের দৃষ্টি, আর ঠিক যার সামনেটিতে দাঁড়ালে মঙ্গলঘন্টা বেজে ওঠে অজান্তে, ধূপ-চাল-ফুল-কর্পূরের গন্ধ ভেসে যায় চারিপাশে, মাথা নত হয়ে আসে, তাকে একটিবার দেখার জন্যে সকাল থেকে পাড়ার মোড়ে অপেক্ষা করা – এ সব কিছু বড্ড বেশি চাকচিক্যবিহীন। চাইতেই হোক বা না চাইতেই হোক, আমরা বড্ড এক ঝলমলে দুনিয়ায় এসে পড়েছি এখন। উপরটুকু ঝলমলে বড়। নিখুঁত। সব কিছু বড় বেশি ঝিকমিক করলে আমার কেমন দমবন্ধ লাগে। ছুটে চলার দুনিয়া। নামীদামি স্কুলে আজকাল পুজো হোক, স্পোর্টস হোক, ড্রেস কোড থাকে। রোজই দামি মোড়কে মোড়া প্রজেক্ট থাকে। বাবা-মায়েদের কিনতে হয় নিত্যনতুন রঙের বাক্স, মোল্ডিং টুলস। নাঃ, আলাদা করে কোনো মাধ্যমকে দোষ দিচ্ছি না। তবে, কোনো কিছুতেই কোনো ধুলো পড়বে না, পুরানো হবে না, একটু মাটির গন্ধ থাকবে না, একটু ভুল হবে না, এমন হলে কেমন যেন সব সময় বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলতে হয় না? সরস্বতীপুজো সে সতর্কতার বিড়ম্বনা থেকে কি মুক্তি দেয় একটু? আমার ছাত্রছাত্রীরা জানে, অনবরত ইংরেজি বলতে স্বচ্ছন্দ হলেও দিদিমণি আসলে সক্কলকে সোনা বা বাবু ডাকেন। নাম ভুলে যান। কেন যে আমরা ইংরেজির সাথে, ভাষার সাথে, মাধ্যমের সাথে, সংস্কৃতির বিরোধ বাধিয়ে ফেলি? আমার এইই স্বভাব। এইই স্বাভাবিক। ইংরাজি পড়াই। ইংরাজি ভালোবাসি। বাংলা মন। বাংলা ভালোলাগা। বাংলা মনন। ঘরের বইয়ের তাকে সারি সারি বই, বাংলাও যত, ইংরাজিও তত। বাংলা মাধ্যমের একটা বড় টানটান আড়ম্বরহীনতা আছে। সরস্বতী পুজোর বাজারের হিসেব নিতে গিয়ে নির্দ্বিধায় বকুনি দেওয়া চলে, ‘কেন অকারণ বেশি কিনলি? এত বড় হলি, বুদ্ধি হল না?’ আল্পনা আঁকতে দিয়ে বলে দেওয়া যায়, অতিরিক্ত রং খরচ না করে করা হয় যেন। আঁকিবুকির পরে সব্বাই একসাথে বসে টিফিন খাবে, তার তোড়জোড় করেন স্যার। ঘামতেলের মত কপাল বেয়ে নামে স্বেদবিন্দু। তাও বকুনি খেতে খেতে, ঝগড়া করতে করতে, প্রশ্রয় পেতে পেতে অক্লান্ত কাজ করে বাংলা মাধ্যম। এই একটা দিন, এই একটা পুজোর দিন, এখনও সরকারি বাংলা মাধ্যমের রমরমা একটুউউ হলেও বেশি। মান রাখতে হবে স্কুলের। কাজ করতে করতে নিমন্ত্রণ করতে আসা গার্লস স্কুলের মেয়েদের দিকে একটু বেশি করে তাকালেই ঠিক একটা চাঁটি পড়বে মাথায়, পিছন থেকে। একটু কায়দা করেই দেখে নিতে হবে তাই। আবার কবে সরস্বতী পুজো আসবে… সেই তো একটা বছর।

ট্রেনের জানলা দিয়ে আলগোছে বাইরে চেয়ে দেখি, হলুদ বসন্ত এসেছে। কোথাও কোথাও ফুটি ফুটি পলাশ। শাড়ি আর পাঞ্জাবির রঙে চরাচর আলো হয়ে আছে। মনটা খুশি খুশি হয়ে যায়। আনমনে স্টেশন চত্বরে হাঁটি। দু’পা এগোতেই এসে পা ছুঁয়ে যায় কোনো প্রাক্তন ছাত্র। আটকাতে চাইলেও পারি না। ঘাড় হেলিয়ে বলে, “ভালো আছেন/আছো? একদিন আসব।” আমি মাথায় হাত দিই, গাল টিপে দিই। এখন দাড়ি হয়েছে। বলি, “আসিস।” ওদের কিন্তু কোনো মাধ্যম হয় না। স্কুল, সে হোক বাংলা মাধ্যম, বা ইংরাজি মাধ্যম, সরকারি, বা বেসরকারি, আসলে একটা আড়ম্বরের ফারাকে চলে, দু’পা আগে-পিছে। ঐ আড়ম্বরটুকু উদযাপনের জন্যে হোক, বা বর্জনের জন্যে, যেটুকু একটু বোধের তফাৎ হয়, তাতেই হয় একটু আটপৌরে ভাব বিয়োগ হয়, না হয় যোগ। না হলে, সরস্বতীপুজোর ভক্তি, ভাব, আনন্দ, সোহাগ, অভিমান, ঝগড়া, এমনকি কুল খেয়ে জিভে টক-টক শব্দ করার দুঃসহ আরাম, সবটাই এক। সবই, ঐ কিছুটা বুঝতে দেওয়ার, আর না দেওয়ার খেলা। যাঁরা আড়ম্বর উদযাপন করেন, হয়তো অনেক সময় বাধ্য হয়ে করেন। যাঁরা বর্জন করেন, তাঁরাও। তবে, অতিরিক্ত আড়ম্বর একরকমের নকলনবিশি আভিজাত্যের বোধ তৈরি করে বোধ হয়। তা ভেতরে লজ্জা আর অপরাধবোধের মত বিঁধতে থাকে। স্কুলের পুজো থেকে তখন শিশুকে একটু নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেন দায়িত্বশীল মা, তাঁর ভালোমন্দের, দৈন্য-আতিশয্যের সাধারণ বোধ থেকে, যখন দেখেন পুজোয় থাকতে গেলে পরতে হবে বিশেষ রঙের শাড়ি বা পাঞ্জাবি। খেলায় অংশগ্রহণ করতে হলে লাগবে বিশেষ পোশাক ও জুতো। প্রজেক্ট তৈরি করতে লাগবে বিশেষ মলাটের খাতা বা স্ক্র্যাপবুক। ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের বিরাট করিডরে দাঁড়িয়ে সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া সেই শিক্ষক, যিনি যে কোনো ব্র্যান্ডের খাতা ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করতে দিয়ে ম্যানেজমেন্টের রোষে পড়েছেন, যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তিনি কোথাও মিলে যান সেই অসহায় দিদিমণির সাথে, যিনি মুখটা দেখে বুঝতে পারেন সকালে খাওয়া হয়নি কিচ্ছু, কিন্তু অভাবটা দূর করতে পারেন না। একটু আড়ম্বর করেই যদি থালা ভরে বেড়ে দিতে পারতেন, মনটা সারাদিন খারাপ থাকত না। 

ভোগবাদের দুনিয়ায় জীবন সরস্বতী পুজোর দুপুরটুকুর মতন আটপৌরে বাসন্তীরং হলে কী যে ভালো হত! কুলের ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ত। “ও স্যার, আর দু’পিস আপেল”… সলজ্জ মুখে চাওয়া যেত। “আজ একটা টিপ পরে যেও কিন্তু”, বলে চোখের কাজল একটুকু আঙুলে নিয়ে কপাল ঘেঁষে লাগিয়ে দিত বিশেষ মানুষ। আজকের এই পুজোর দিনে ফুলেফেঁপে ওঠা রেস্তোরাঁ, পথে ঘাটে দু’চাকার তেজি গর্জন, হাওয়ায় উড়তে থাকা স্ট্রেট করা বাদামি চুলের শলাকা, আর রাসায়নিক সৌন্দর্যের ভিড়ে একটু যদি বেঁচে থাকত মায়াঘেরা, ছাপোষা, লাজুক বাংলা মাধ্যম I


By Saheli Sengupta

Professionally a teacher, Saheli has a zeal for creative writing. Mukta Gadya (Open/ Free Prose) and poetry are her comfort zones, and she principally uses her social handles to publish them. Her writings have been published in different webzines and magazines. Saheli is based in Kalyani, a city a little away from the hustle-bustle of Kolkata, and thus is a lover of nature and solitude. She is passionate about her profession, music and creative writing. She can be reached at sahelisen1989@gmail.com

Facebook Comments

WhatsApp
Facebook
Twitter
Email
LinkedIn

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social Media

Most Popular

Get The Latest Updates

Subscribe To Our Weekly Newsletter

No spam, notifications only about new products, updates.

Veda's Exclusive

Get Ready to Turn Heads with Our Stunning Sarees!