Being Women

বাড়ির বউরা করবে না তো কারা করবে?

এ রান্নায় স্নেহ আছে, মায়া আছে, আনন্দ আছে; আর আছে ছোটবেলা থেকে রক্তে মিশিয়ে দেওয়া বিশ্বাস; বাড়ির বউরা করবে না তো কারা করবে?

“রাতে খেয়েদেয়ে আমরা যখন ঘুমোতে যেতাম, তখন মা কোমর বেঁধে কাজে নামত। জানো দিদি, কোনোদিনও তলিয়ে দেখিনি যে মায়ের ওপর দিয়ে ঠিক কতটা ধকল যায়। কত রাত পর্যন্ত কাজ করে। আদৌ ঘুমত কি? আমরা  সক্কাল-সক্কাল উঠে, স্নানটান সেরে খোঁজ করতাম জলখাবারের। সে কী প্রবল আগ্রহ! ছানাপোনা-বুড়োবুড়ি মিশিয়ে পনেরোজনের ঢাউস সংসার। সে’খানে খাওয়াদাওয়া মানেই একটা হইহইরইরই ব্যাপার”।

—- 

জুঁইর মনে হচ্ছিল ওর কাঁধে যেন কেউ ক্রমাগত হাজার হাজার ছুঁচ বিঁধিয়ে চলেছে। এই বিশ্রী ব্যথাটা অনেকদিন ধরেই আছে। তবে এ’বার একটা ডাক্তার না দেখালেই নয়। কিন্তু সময় কই? কাজ, ছেলেমেয়ের স্কুল-পড়াশোনা, ঘরদোর সামাল দেওয়া। নাহ্‌। সে’সব ভেবে দমে গেলে চলবে না। এ’বয়সে স্পন্ডেলাইসিস ধরে গেলে তো সংসারটাই যাবে ভেসে। কাল-পরশুর মধ্যে একবার সময় করে যেতেই হবে ডাক্তারের কাছে। যেতেই হবে! এ’সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রান্নাঘর থেকে বেডরুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল জুঁই, পাশে জুঁইর বছর পাঁচেকের নীল ঘুমিয়ে এক্কেবারে কাদা। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালে ব্যথা যেন সামান্য কমে আসে। তখনই জুঁইর মনে পড়ল, এই যাহ্‌। মাংসটা ম্যারিনেট করা হয়নি তো! কাল ওর হাতের মাংস কষা না হলে তো খাওয়াদাওয়াটাই মাটি। এতগুলো লোক উৎসুক হয়ে বসে আছে, জুঁই রকমারি পদ টেবিলে সাজিয়ে দেবে, তাঁরা হামলে পড়বে। জুঁই যে কী তৃপ্তি পায় সবাইকে পাত পেড়ে খাইয়ে। শুধু এই পোড়া কাঁধের ব্যথাটাই…। ধুর! পাত্তা না দিয়ে এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে উঠল সে। ঘড়িতে তখন পৌনে দু’টো।

—-

“জানো দিদি। সবাই মিলে খেতে বসে দেখতাম থরেথরে সাজানো রকমারি পিঠে। চিতই পিঠে, চুষির পায়েস, পাটিসাপটা, মালপোয়া, ঘুগনি আরও কত কী।  পাশাপাশি থাকত গরম চা, মাটির ভাঁড়ে।  আহ্‌, সে’সবের স্বাদ-গন্ধ মনে পড়লে এখনও জিভে জল আসে। সব কিছুই যেন এক্কেবারে নিখুঁত। সবাই মিলে আমরা কী মজাটাই না করতাম, দিদি! আর সবটাই হত শুধু মায়ের জন্য। এরপর আমরা তো পিঠে খেয়েই খালাস। কিন্তু মায়ের কাজ সে’খানে শেষ হত না। সংক্রান্তি দিনটা ভালো, তাই দুপুরের দিকেও ভালোমন্দ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হত। আর পুরো দায়িত্বটাই মায়ের ঘাড়ে। কুটনো কোটা, রান্নাবাড়া, বাসনমাজা, সমস্ত। অথচ দ্যাখো, আমার কোনোদিনও মনে পড়ে না যে মাকে আমরা কেউই কোনোদিনও বিশেষ সাহায্য করেছি বলে। অবিশ্যি, মা নিজেও কোনোদিনও মুখ ফুটে বলেনি। বলবেই বা কী করে। মুখ বুজে কাজ করে যাওয়াটাই তো বাড়ির বউঝিদের ধর্ম। মা এ’বাড়িতে আসার আগে আমার ঠাম্মাও চিরকাল তাই করে এসেছে। এ’ভাবেই চলে আসছে হয়ত, চিরকাল”। 

—-

একটা কাজ থেকে কী অদ্ভুতভাবে অন্য হাজারটা কাজ বেরিয়ে এসে; ব্যাপারটা ভেবে নিজেই একবার ফিক করে হেসে উঠল জুঁই। এসেছিল মাংসটা ম্যারিনেট করতে; বড়জোর মিনিট পনেরোর কাজ। হঠাৎ জুঁইর মনে হল কালকের কিছু কাজ এগিয়ে না রাখলে সময়মত সবকিছু করে ওঠা হবে না। তারপর যা হওয়ার তাই হল। পেঁয়াজ কুচিয়ে, মশলা বেটে, তিন রকমের মাছ ভেজে, ডাল সেদ্ধ করে, টমেটো-আমসত্ত্বের চাটনি বানিয়ে যখন জুঁই খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলে, তখন আকাশ রীতিমত ফর্সা। খানিকক্ষণ পরেই সবাই উঠে পড়বে। ক্লান্তি সত্ত্বেও, ঝিমটি দিয়ে এমন সুন্দর ভোরটা নষ্ট করতে মন সরল না রুমার। এক কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় এসে বসল সে। নিজের জন্য আলাদা করে এক কাপ চা বানাতে বেশ লাগল রুমার।

আহ্‌, ভোরের হাওয়া কী মিষ্টি। পাড়াটা এ’সময় কী নিরিবিলি, কী শান্ত। আরামে চোখ বুজে আসছিল জুঁইর। তন্দ্রা ভাঙল শাশুড়ির হাঁকডাকে। ঘুম থেকে উঠেই অপরিষ্কার রান্নাঘর দেখে বেশ খানিকটা তিতিবিরক্ত তিনি। চায়ের কাপ ফেলে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল জুঁই।

***

“জানো, মায়ের বিয়ে খুব অল্প বয়সে হয়েছিল। তখন মা সবে বারো। আর আমাদের মত সংসারে যা হয় আর কী, বিয়ে করে আসার পরের দিন থেকেই গেরস্তবাড়ির সমস্ত দায়দায়িত্ব গিয়ে পড়ল মায়ের ওপর। অতটুকুন বয়সে সব কি আর মা শিখে এসেছিল? না। অনেক ভুল করেছে, হোঁচট খেয়েছে, ঠেকে শিখেছে। কিন্তু হাল ছাড়েনি।  আর সংক্রান্তির দিনগুলোতে, এই যে মা এতরকমের পিঠে বানাত, সে’সবই অন্যদের শখ-আহ্লাদ মাথায় রেখে। নিজের ভালো-লাগার কথা ভেবে কখনও কিছু রাঁধতে দেখিনি মাকে। আর খাওয়ার পাতে ঠাম্মা যেমন যা সাজিয়ে দিত, যতটুকু দিত; তাই সোনামুখ করে খেয়ে নিত। কোনোদিনও টুঁ শব্দটি করেনি। একটি বারের জন্যও নিজের ভালো লাগা-মন্দ লাগা নিয়ে কিচ্ছুটি বলেনি। এখন আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, ওই উৎসব-পার্বণের রাতগুলোতে, মা যখন আমরা ঘুমোতে যাওয়ার পরে হেঁসেলে ঢুকত, গোটা-রাত আদৌ দু’চোখের পাত এক করার সুযোগ পেত কি? নাকি সবার জন্য ভালোমন্দ রাঁধতে রাঁধতে রান্নাঘরে বসেই ভোরের আলো দেখতে পেত? জানো, আমরা কেউ কোনোদিনও মায়ের কাজের ভার লাঘব করতে এগিয়ে যাইনি। আমরা এগিয়ে এলে হয়ত বেচারি দু’দণ্ড শ্বাস নিতে পারত, তাই না? তা’ছাড়া কী অত্যাচারটাই না ঠাম্মা মায়ের ওপর করত। আচ্ছা, মা কি কখনও মনে মনে চায়নি যে আমরা কেউ সে’সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই? কে জানে। সত্যি কথা বলতে কী, তখন অবশ্য এ’সব বুঝতেও চাইতাম না। কিন্তু এদ্দিন পর; আজ তোমায় দেখে আমার মায়ের কথা বড় মনে পড়লো। কত পরিশ্রম করে পিঠে বানাচ্ছ, ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছ, নিজের ব্যবসা সামলাচ্ছ! ওপর-ওপর দেখলে তোমার আর আমার মায়ের মধ্যে কত তফাৎ। অথচ দেখো, সব মেয়েমানুষের কপালই সেই একই অপদেবতার হাতে গড়া।  পড়াশোনা বা টাকাপয়সায় তাঁদের ভাগ্যের চাকা ঘোরেনা”। 

********* 

শ্যামলীদি রান্না করতে করতে কত গল্প করে। সে’সব গল্প জুঁই গোগ্রাসে গেলে।

আজ শ্যামলীদি শুরু করেছিল নিজের ছোটবেলা আর মায়ের গল্প। বেকিং ওভেনে কাজ করতে করতে অবাক হয়ে শুনছিল জুঁই। শুনতে শুনতে বারবার মনে হচ্ছিল;  আরে, এগুলো তো আমাদেরই কথা। আমারই কথা। আমাদের এই বারোমাসে তেরো-পার্বণ, এত হই-হুল্লোড়; এ সমস্তকিছু এ’দেশের মেয়েদের শরীরে এবং মনে যে কী নিদারুণ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সে আনন্দে কি জুঁইও গা ভাসিয়ে দেয় না? দেয় নিশ্চয়ই।  কিন্তু তা’তে সে বোঝার ভার হালকা হয় কি? না বোধ হয়। অবশ্য জুঁই কতটুকুই বা জানে। শ্যামলীদির মাও নিশ্চয় এর সদুত্তর দিতে পারতেন না।

এই রান্নাবান্নার দায়ভার কেউ জুঁইর ওপর চাপিয়ে দেয়নি অবশ্য; জুঁই সে’টা জানে, বিশ্বাস করে। নেহাত ভালোবাসার টানেই এ’সব রেঁধেছে সে; তাঁর ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্য। এ রান্নায় স্নেহ আছে, মায়া আছে, আনন্দ আছে; আর আছে ছোটবেলা থেকে রক্তে মিশিয়ে দেওয়া বিশ্বাস; বাড়ির বউরা করবে না তো কারা করবে?


STORY BY VEDAPRANA PURKAYASTHA, TRANSLATED BY THE EDITORIAL TEAM !

By Vedaprana Purkayastha

The Founder of The She Saga, The She Saga Foundation and Veda’s, Vedaprana is an Entrepreneur, a Social Worker and an Empowerment Coach. She writes on topics that touch her heart and stirs her soul. She can be contacted at vedaprana.p@gmail.com

Facebook Comments

WhatsApp
Facebook
Twitter
Email
LinkedIn

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social Media

Most Popular

Get The Latest Updates

Subscribe To Our Weekly Newsletter

No spam, notifications only about new products, updates.

Veda's Exclusive

Get Ready to Turn Heads with Our Stunning Sarees!