“কেমন লাগল?” পিছনের সীট্ থেকে আসা প্রশ্নটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু ব্রাত্য শুনতে না পাওয়ার ভান করে সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিলেন। জানতেন পাশে বসা মহুল কথাটা লুফে নেবে। হলোও তাই।
“ভালোই তো লাগল। দেখতেও ভালো। ঘ্যাম নেই। বাবা-মাও ঠিকঠাক।”
“হুঁ। আমার মোটামুটি পছন্দই হয়েছে; তোর সঙ্গে সব দিক দিয়েই মানানসই। স্কুল টিচার,আরামের চাকরি, সংসারও সামলাতে পারবে।”
“কী,চুপ করে আছো,তুমি কিছু বলছ না কেন?” আবার পিছনের সীট থেকে খোঁচা খেলেন ব্রাত্য।
“আঃ ট্রাফিকের অবস্থা দেখছনা!” ঈষৎ বিরক্তি মিশিয়ে উত্তর দিলেন। সফলভাবে গুগলিটা খেলে দিয়ে মনে মনে নিজের পিঠটা নিজেই চাপড়ে নিলেন। আগে থেকে আঁচ করেই ব্রাত্য ড্রাইভার আনেননি। নিজে গাড়ি চালালে সেই ছুতোয় আলোচনাটা সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া যাবে।
পিছনের সীট থেকে অস্ফুট কন্ঠে ভেসে এলো,”এবার আর কোনও গোলমাল হবে না। আমি আগে থেকে কাউকেজানাইনি;না আত্মীয়স্বজনদের না বন্ধুবান্ধবদের।” দু দুটো ভালো সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়াতে সুমিতা এবার মরিয়াহযে উঠেছেন।
এবার আর না বলে পারলেন না ব্রাত্য,”বিয়ে ঠিক হলে তো বলতেই হবে।”
তারপর ছেলের দিকে চোখ টিপে হেসে পরিবেশটা হাল্কা করতে বললেন, “তুই কি ইলোপ করবি ভাবছিস?”
সুমিতা ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন,”সব জিনিস নিয়ে তোমার খালি ঠাট্টা।”
মহুল বলল,”ইলোপ করলে তো জামাই আদর পুরো মিস্। আজকের জলখাবারটা কিন্ত দারুণ বানিয়েছিলেন। আত্রেয়ী তো বলল সব নাকি ওর মা বানিয়েছেন, শুধু মিষ্টিটা দোকান থেকে কেনা।”
“সত্যিই, মাছের কচুরির স্বাদটা এখনও মুখে লেগে রয়েছে।” এই যাঃ! মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল।
“ওই জন্য ওই মহিলার সঙ্গে গায়ে পড়ে হেসে হেসে অত কথা বলছিলে?”
জবাব না দিয়ে ব্রাত্য গম্ভীর মুখে গাড়ি চালানোয় মন দিলেন। এই অভিযোগ সুমিতার মুখে নতুন নয়। পুরনো কথা কখনও ভাবতে বসলে মনে মনে অবাক হন। সেই বাইশ বছরের যুবতী, যার গান শুনে একদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন ব্রাত্য, বিয়ের পর সেই মেয়েটা যে কোথায় হারিয়ে গেল। ব্রাত্য সুপুরুষ, কিন্ত ছোটখাটো গড়নের সুমিতা ডানা কাটা পরী না হলেও একসময় বেশ আকর্ষণীয় চেহারা ছিল। আর সঙ্গে অপূর্ব গানের গলা। কলকাতার নামী
একটি সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী ছিল। কিন্তু সুমিতার সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মন তাদের সংসারটা ছারখার করে দিয়েছে। বরাবরই মিশুকে ব্রাত্যর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অজস্র বন্ধু ছিল, মহিলা-পুরুষ দুইই কিন্তু, আজ আর কারোর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। সরকারি চাকরি করেন তবুও সার্ভিসে নিজের ব্যাচমেটদের এড়িয়ে চলেন। পুরুষ বন্ধুদের স্ত্রীরা আছেন, তাদের দেখলেই সুমিতার মুখ গোমড়া হয়, কথা বললেই নানান রকম সন্দেহ, বাড়ি ফিরে অশান্তি, চিমটি কেটে কথা বলা, রাগ করে না খাওয়া – দিনের পর দিন এই মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি হওয়ার পর হাল ছেড়ে দিয়েছেন ব্রাত্য। যদি সত্যিই লম্পট হতেন তাহলে হয়ত কিছুই গায়ে মাখতেন না। কিন্তু ব্রাত্য বরাবরই পারফেক্ট জেন্টলম্যান। সুমিতার মিথ্যে সন্দেহ তার অহংয়ে আঘাত করেছে, লজ্জায় ঘৃণায় ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে গেছেন, যেন সমাজের চোখে চোখ রেখে তাকানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, যার গান শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে তার মনে যে এতো বিষ থাকতে পারে চোখের সামনে না দেখলে তিনি কোনোদিন বিশ্বাস করতেন না।
মহুলের প্রশ্নে আবার বর্তমানে ফিরে এলেন ব্রাত্য। “আচ্ছা মা,ওই ছেলেটা কে বলো তো?”
ব্রাত্য বলতে যাচ্ছিলেন কোন জন কিন্তু তার আগেই সুমিতা বলে উঠলেন,”যে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে ভিতরে নিয়ে গেল?”
আত্রেয়ীর বাড়িতে অত লোকজনের মধ্যেও ছেলেটা ব্রাত্যর নজরে পড়েছিল। লম্বা,রোগা,মুখে আলগা শ্রী রয়েছে। বেশ সপ্রতিভ। বড় রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল ওদের জন্য। তারপর গলিতে গাড়ি রেখে, পথ দেখিয়ে আত্রেয়ীদের বাড়ি নিয়ে গেছিল। আত্রেয়ীর বাবা যখন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তখন ছেলেটিকে নিয়ে কি কিছু বলেছিলেন, ভ্রু কুঁচকে ভাবার চেষ্টা করলেন।
“ও কিছুতেই আত্মীয় নয়। ওকে আমি শুধু আত্রেয়ী, ওর বাবা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। অন্যরা কিন্তু তেমন চেনে না।” মহুল বলল জোর গলায়।
“আমি তোর আগেই আত্রেয়ীর মাকে প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছি। ওনার স্বামীর এক ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে, বাবা-মা উত্তরবঙ্গে থাকেন। ছেলে এখানেই পড়াশোনা করেছে, হস্টেলে থাকত কিন্তু এঁরাই ছিলেন লোকাল গার্জেন। আসা-যাওযা লেগেই থাকে। এখন বেলেঘাটার সেলস ট্যাক্স অফিসে চাকরি করে। দেখে শুনে তো ঠিকই লাগল,কিন্তু ভিতরে কোনও লটর পটর আছে কিনা সে আমি জানি না বাপু।”
মহুলের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তোর্সার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই মায়ের ক্রমাগত চাপে সে মেয়ে দেখতে রাজি হয়েছিল। মহুল আর সুমিতা জানে না ইউ.এস. যাওয়ার আগে অফিসে ব্রাত্যর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তোর্সা। বলেছিল মহুলের অতিরিক্ত অধিকারবোধ বা পজেসিভনেস এবং সন্দেহপ্রবণতার কথা।
সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পরও নিস্তার নেই, ফোন, মেসেজ, ক্রমাগত সাইবার স্টকিং, ব্লক করলে ফেক আইডি দিযে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো, শেষে নাজেহাল হয়ে অনসাইটে পোস্টিং এর দরখাস্ত করে। পরের সপ্তাহে চলে যাবে। ব্রাত্য সব শুনে তোর্সার কথা অবিশ্বাস করেন নি। তিনি তো গত তিরিশ বছর এই নরক যন্ত্রণাই ভোগ করে চলেছেন। শুধু নিজের একমাত্র ছেলের জন্য বড় কষ্ট হয়। ছেলে মনমরা হয়ে পড়েছে, এই
ছুতোয় তার কাউন্সেলিং করানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মা-ছেলে তা উড়িয়ে দিয়েছে। উল্টে ছেলের আবার বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন সুমিতা। আরো একটা জীবন নষ্ট হতে চলেছে। কিন্তু ব্রাত্য নিরুপায়।
“আমি কিন্তু এসব নোংরামো সহ্য করব না, তাতে বিয়ে যদি না হয়, হোক” মহুল ঘোষণা করল।
“আরে সব খোঁজ খবর নিয়েই এগোবো। আর কোন অঘটনও ঘটবে না। কাক পক্ষীও টের পাবে না। তুই চিন্তা করিস না।”
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন সুমিতা, “বেনামে যে কে লিখে পাঠাচ্ছে মেয়ের বাড়িতে চিঠিগুলো, একবার জানতে পারলে মজা দেখাতাম। ভাগ্য ভাল তাই গতবার মুখুজ্জে মশাই চিঠিটা এনে দেখালেন। আমার মনে হয় ওই তোর্সা রাক্ষসীর কাজ। এখন হাত কামড়াচ্ছে, তাই তোর বিয়েতে বাগড়া দিচ্ছে।”
“শুনছো, কাল একটু সকাল সকাল অফিস যাব। একটা দরকারি কাজ আছে।” বললেন ব্রাত্য। সুমিতা ঘাড় নাড়লেন শুধু, মহুলের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত।
ব্রাত্য মনে মনে আগামীকালের ছকটা কষে নিলেন। অফিসে চিঠির ফরম্যাটটা কম্পিউটারে করাই আছে। শুধু নাম-ধাম বসিয়ে দিলেই হবে। আর লিখে দিতে হবে চিঠির কথা গোপন রেখে খোঁজ-খবর করতে। অবশ্য দেখালেও ক্ষতি নেই। খামের ওপর লেখা ঠিকানাও টাইপ করেই পাঠান। শুক্রবার ড্রাইভার আসে না। নিজেই ড্রাইভ করে অফিস যাওয়া-আসা করেন। সেদিনই ফেরার পথে একটু দূরের কোন পোস্ট অফিসের সামনে ঝোলানো ডাকবাক্সে চিঠিটা পোস্ট করে দেবেন। যতোই সন্দেহপ্রবণ মন হোক, উড়ো চিঠির প্রেরক কি আর পাত্রের বাবা হতে
পারে?
By Anindita Chowdhury
Anindita Chowdhury is a special correspondent of the English daily, The Statesman. She is based in Hyderabad. Apart from reporting, she writes short stories and essays with special focus on history, particularly the social and cultural aspects of the bygone era. She can be contacted at aninditasmail@gmail.com.
Facebook Comments